আমজাদের মেয়েটা এসেছে বাবাকে দেখতে। মেয়ের নাম আয়েশা। সে এক হাতে তার মৃত বাবার ডান হাতের আঙুল ধরে আছে। বাঁ হাতে ক্রমাগত আঁকিবুকি করছে মাটিতে। আমজাদ প্রায়ই লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে দেখতে যেত। এটা সেটা কিনে দিতো। কিন্তু আয়েশার মা তা পছন্দ করতনা। তারপরও সে যেতো। মেয়ে বলতো, ‘তুমি আমারে লুকাই লুকাই দেখতে আসো কেন আব্বা? আর সবাইর আব্বা তো তাদের লুকাই লুকাই দেখতে আসে না?’
‘কই নিয়া যাইবা?’
‘জলডাঙা।’
‘সেইখানে নিয়া কী করবা?’
‘সেইখানে অনেক পুতুল পাওয়া যায়। আপনারে আমি একটা পুতুল কিন্যা দিব।’
‘বড় পুতুল?’
‘হুম।’
‘কত বড়?’
‘আপনার সমান আম্মা।’
‘সেই পুতুলে কথা বলতে পারে?’
‘পারে।’
‘কী কথা বলে?’
‘আপনে বলেন আম্মা, কী কথা বললে আপনার ভালো লাগবে?’
এই প্রশ্নে আয়েশা চুপ করে থাকত। অনেকটা সময়। তারপর বাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলত, ‘পুতুলডা আমারে দেখলেই বলবে, আয়েশা মাইয়াডা একদম তার বাপের মতন হইছে। এই বাপ-বেটি মিল্যা আমার কইলজাডা জ্বালাই খাইল।’
‘এই কথা কেন বলবে আম্মা?’
আয়েশা খিলখিল করে হাসত, ‘আমাগোর পাশের বাড়ির আদিবার মা সারাক্ষণ খালি আদিবারে এই কথা বলে। বলে, ‘মাইয়াডা একদম বাপের মতন হইছে। বাপটাও আমারে শান্তি দেয় না, মাইয়াডাও না। এই বাপ-বেটি মিল্যা আমার কইলজাডা জ্বালাই খাইল।’
বলেই আবার হাসে আয়েশা। তবে তার চোখ ছলছল করতে থাকে। সে ভেজা গলায় বলে, ‘আদিবার আব্বা আর আদিবা তখন মায়ের কথা শুইনা কী করে জানো আব্বা?’
‘কী করে?’
‘একজন আরেকজনরে জড়াই ধইরা খালি হাসে। খালি হাসে। তার মা তখন তাদের আরও বকতে থাকে। আরা তারা দুইজন তখন আরও হাসতে থাকে। তারপর আদিবার আব্বা আদিবারে ধইরা একশ চুমা দেয়। আদিবার মায় তখন কী বলে জানো?’
‘কী?’
‘বলে বাপ-বেটির ঢং দেখে আর বাঁচি না। গায়ে আগুন ধরে যায়। এতো ঢং যে এরা কইত্থেকে শিখছে! আদিবা তখন তার আব্বার গলা জড়াই ধরে বলে, বাপের কাছ থিকা শিখছি। আমার বাপের কাছ থিকা শিখছি। আমি হইলাম বাপের মাইয়া। বাপের মতন হইছি। বলে কী যে হাসি তার! ’
আয়েশার গলা ভেজা। সে সেই ভেজা গলায়ই বলে, ‘আমার তখন খালি কান্দন পায় আব্বা। খালি কান্দন পায়।’
আমজাদ তখন বলার মতো আর কোনো কথা খুঁজে পায় না। কী বলবে সে? তার গলা শুকিয়ে আসে। বুক ধড়ফড় করে। সে মেয়েকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলে, ‘সবার আব্বাতো আর ভালো আব্বা হয় না মা। তাই তোমার আব্বায়ও আদিবার আব্বার মতো হইতে পারে নাই। ’
আয়েশা অবশ্য বাবার কথা মানে না। সে ফিসফিস করে বলে, ‘তুমি সবচাইতে ভালো আব্বা। এই দুনিয়ায় তোমার চাইতে ভালো আব্বা আর নাই। তুমি এখন একটা কাজ কর।’
‘কী কাজ আম্মা?’
‘তুমি এখন আমারে জড়াইয়া ধইরা চুমা দাওতো। কয়টা চুমা দিবা জানো?’
‘কয়টা?’
‘একশ একটা।’
‘একশ একটা কেন?’
‘কারণ আদিবার আব্বা আদিবারে প্রত্যেকদিন একশটা চুমা দেয়। তুমি আমারে দিবা একশ একটা। একটা চুমা বেশি দিবা।’
আমজাদ কথা বলতে পারে না। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। হৃদস্পন্দন থেমে যেতে চায়। বুক হাসফাস করতে থাকে।
~ আগুনডানা মেয়ে।
সাদাত হোসাইনের নতুন উপন্যাস। আসছে ২০২৪ বইমেলায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
House Of Al Towfiqi https://htorg.blogspot.com/2025/02/towfiq-sultan.html